মসজিদে মিম্বরের মাইকে ধ্বনিত হচ্ছে “হাইয়া আলাস সালাহ, হাইয়া আলাল ফালাহ” (নামাজের জন্য আসো, কল্যাণের জন্য আসো)। আমার ঘর থেকে মসজিদের দূরত্ব ৩৫/৪০ ফুট হবে; মধ্যে শুধু একটি রাস্তা পার হতে হয়। মসজিদে নামাজের আহ্বান শুনে যাঁরা মসজিদে গেলেন মুয়াজ্জিন সাহেব তাঁদেরকে মসজিদে নামাজ না পড়ে ঘরে যেয়ে নামাজ আদায় করতে বিনয়ের সাথে বললেন। মুয়াজ্জিন সাহেব আগে ঘোষণাও দিয়েছিলেন যে সবাই রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঘরে নামাজ পড়বেন। তাই আমিও মসজিদে যেতে না পেরে তিন তলায় দাঁড়িয়ে প্রিয় মসজিদটিকে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছিলাম।
যাঁরা আযানের ধ্বনি শুনেনি বা শুনেও হয়তো ভেবেছিলেন, আল্লাহর ঘরে গেলে কি ফিরিয়ে দেবে! আমার কথা অবশ্য এখানে নয়; লকডাউন সেটি হতে পারে। মানুষের বাঁচার জন্য ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী কাবা ঘর পর্যন্ত লকডাউন। মসজিদের দিকে তাকিয়ে আমার এতোটাই মায়া লেগেছিলো, আমার চোখ দিয়ে পানি এসে গেলো। মনে হয়েছিলো আল্লাহর ঘর খুবই সুন্দর মসজিদ যেনো তাকিয়ে তাকিয়ে কান্নার সুরে অভিযোগ করছে, আর বলছে তোমরা পাপ করে করে আল্লাহর রাগ এতোটাই বাড়িয়ে দিয়েছো যে তিনি তোমাদের পাপীর দলকে আল্লাহর ঘর থেকে বের করে দিয়েছেন। কাবা ঘরে পর্যন্ত এসব হাতের ছোঁয়া লাগতে দিচ্ছেন না। ভেবেছিলাম কবরে যখন মানুষ যায় তখন সেও হয়তো চিরনিদ্রায় শুয়ে থেকে মসজিদে মুয়াজ্জিনের আযানের ধ্বনি শুনতে পায় কিন্তু কী হবে সেখান থেকে তো আর মসজিদে নামাজের আহ্বানে আসা সম্ভব নয়। ভাবতে ভাবতে গায়ে যেনো ভয়ের একটি শিহরণ দিয়ে উঠলো। আমরা কি তাহলে বন্দিজীবনে সেই প্র্যাকটিস শুরু করে দিয়েছি?হায় আল্লাহ! আমরা পাপীর দল কিন্তু তোমার দয়া এর চেয়ে বহু ট্রিলিয়ন গুণ বেশি যা পার্থিব কোনো পরিমাপকের সূচকে আন্দাজ করা যাবে না। তুমি আমাদের মাফ করে দাও। এক সময় ঈমাম সাহেব আর মুয়াজ্জিন সাহেবের দিকে তাকিয়ে পলকের জন্য মনে হয়েছিলো তাঁরা কতোটা ভাগ্যবান যে তাঁরা আল্লাহর ঘর আবাদ করার জন্য সেখান থেকে অন্তত আমাদের মতো বিতাড়িত হয়নি। আল্লাহ ভালো জানেন। হঠাৎ করেই কেমন যেনো একটি আশার বাণী মনের মধ্যে বিড়বিড় করে বলে উঠলো; না না ঠিক এমনটি নয়। আল্লাহ কি শুধু মসজিদেই থাকেন, তিনি তো সর্বত্র সর্বজনে বিরাজমান। তাহলে তিনি তো পাশেই আছেন, অতি নিকটে। বাহ্।। তিনি হয়তো চাচ্ছেন, এবার আমরা কিছু সময় আমাদের আপন আপন ঘরগুলোকেও আবাদ করি, এখানেও যে তিনি মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বিরাজমান তা উপলব্ধি করি। আমরা অনেকেই হয়তো আল্লাহর ঘর ভেবে আল্লাহকে মসজিদ – মাদ্রাসায় রেখে আসি, আস্তাগফিরুল্লাহ। কেননা মসজিদ থেকে বের হয়েই মিথ্যা, গীবত, যেনা, মদ, ঘুষ, সুদ, অপরের সম্পদ হরণ বা লোভ ইত্যাদি নানা অপকর্মে লিপ্ত হয়ে যাই। আমরা তো এভাবেই ঘরকে নানা অজুহাতে কলুষিত করে ফেলেছি। ব্যক্তিক অহংকার আর কুরুচিপূর্ণ ধর্ম বিবর্জিত মানুষের মস্তিষ্ক তাড়িত সংক্রমিত অদৃশ্য করোনা ভাইরাসের মতো আর একটি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে নিঃশেষ করে ফেলেছি মানুষরূপী আমাদের মানবিক সত্তা গুলোকে।যাইহোক, তারপর ঘরেই ঈমামতি করলাম এশার নামাজের। আমার পেছনে আমার দুই ছেলে তাদের পেছনে আমার স্ত্রী এবং আমার আম্মা নামাজের কাতারে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমার কি যে অনুভূতি হয়েছিলো তখন – তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়! নামাজ শেষে মোনাজাত করে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করে সাহায্য কামনা করলাম আর দোয়া করলাম যাঁরা পরিবার ছেড়ে দিয়ে শুধুই মানুষের কল্যাণে মাঠেঘাটে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন – স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ, জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, পৌর প্রশাসন, সেনাবাহিনী, জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক, ডাক্তার, নার্স, বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাকর্মী এবং সামাজিক সংগঠনগুলোর সমাজকর্মী – সকলের জন্য। আজ সকলের প্রতি বিনীত আহ্বান জানাতে ইচ্ছে করছে, প্লিজ, প্লিজ, আমরা যতোটা পারি সদকা মানে দান করি আর একে অপরের জন্য দোয়া করি; নামাজ পড়ি, কোরআন শরিফ তিলাওয়াত করি, আল কোরআানের অর্থ বোঝার চেষ্টা করি। নিশ্চয়ই আল্লাহর পরীক্ষা শেষে তিনি তাঁর অপার মহিমায় কোনো একদিন উদিত রূপালি সূর্য হাসিতে আমাদের শুদ্ধ স্নাত ভালোবাসায় তাঁর ঘরে টেনে নিয়ে যাবেন, ইনশাআল্লাহ।। “স্টে হোম, স্টে সেইফ এন্ড রিমেম্বার ক্রিয়েটর।”# ফ্যাক্ট: লকডাউন, করোনা ভাইরাস।
সোপানুল ইসলাম সোপান (বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ)
অধ্যক্ষ- আইডিয়াল রেসিডেন্সিয়াল স্কুল এন্ড কলেজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
Leave a Reply